এরপর কথা শুরু হতে গিয়ে দাগের ওপর দিয়ে আবার চলাচল করল। সুকুমারকে পাটা মারতে দেখা যায়। সব ঠিকঠাক থাকে। খালি পাটার আওয়াজ হয় ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ থ্যাস। আর কোদালের আওয়াজ হয় খ্যারর খ্যারর। কর্নিকের আওয়াজ থ্যাস থ্যাস থুপুস। সব আওয়াজ থেমে গেলে নিঃশব্দ হয়। চারদিক নিঃশব্দ না হলেও একটুখানি জায়গা যেখানে কাজকাম হচ্ছিল নিঃশব্দ হয়ে পড়ল তারপর সেটা হয়ে উঠল এমন এক নরম সরম জায়গা যেখানে খুব শিগ্গির শক্তপোক্ত এক আস্তরণ গড়ে উঠবে। সে রোদ আসুক আর না আসুক। দিনের শেষে বা রাতের শুরু আস্তে আস্তে নরম সরম জায়গার সিমেন্ট জমাট হয়ে যাবে। সেখানে তখন দাগের সম্ভবনা তৈরি করতে তিনটে কুকুর ঘোরাফেরা করতে করতে নানান দাগ সত্যিই তৈরি করছিল। সে সব ঘুরে ঘুরে নরম জায়গার আসপাশে তৈরি করা দাগেরা। ... ...
লোকটি শাহানার দেবর। তাকে আমি প্রথম দেখি শাহানার বৌভাতে। খাওয়ার টেবিলে আমাকে খুব সমাদর করছিল। যে বিষয়টি অন্য সবার থেকে লোকটিকে আলাদা করে তোলে তা হচ্ছে তার অদ্ভুত হাসি। তার হাসিতে কিছু একটা ছিল। রহস্যময়। দেখে মনে হয় বলছে – আমি সব জানি। জানি না কেন, আমার খুব অস্বস্তি লেগেছিল। লোকটির নাম আমার মনে নেই। মাহমুদ, মাসুদ কিংবা মাহতাব হতে পারে। তবে কেউ একজন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, লোকটি শাহানার দেবর। শাহানার শ্বশুরবাড়িতে ঐবারই আমার প্রথম এবং শেষ যাওয়া হতে পারতো, হয়নি। ... ...
শৈশবের যে সময়কালের বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতি কেবল মানুষের মনে থাকে ঐ বয়স থেকে বাহ্রামের কাছে ‘পরী’ একটা আকর্ষণীয় বিষয়। বাহ্রামের মা বলতেন, বাহ্রাম যখন সবে হাত বাড়াতে শিখেছে তখনই সে কোন পরীর ছবি দেখলে খটখটিয়ে হেসে উঠে হাত বাড়াতো। সে কথা সত্যি হোক বা না হোক জ্ঞান হবার পর থেকে পরীর ব্যাপারে বাহ্রামের আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং দিনে দিনে তা একটু একটু করে বেড়েছে। ... ...
রহমান ৩০ বছর ধরে কামারহাটিতে থাকে। আজ থেকে ২৩ বছর আগে রহমানের আব্বা,আফজল, সুস্থ মানুষ,হজ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পাওয়া যায় নি। রহমানের মা সাকিরা আগে খুব কাঁদত। তারপর আল্লার কাছে দোয়া করত, জলজ্যান্ত লোকটাকে ফিরিয়ে দাও। তারপর শুধু চিৎকার করত। একদিন চুপ করে গেল। সারাদিন ধরে ঘরে বসে থাকত। কোনো সাড়াশব্দ নেই। তিনবার পানি খেতো, একবার ভাত। তার চোখে পানি নেই.. সব শুকিয়ে গেছে। রহমান বাসায় ফিরে এলে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত। লোকে বলে রহমানকে দেখতে তার হারিয়ে যাওয়া আব্বা আফজলের মতো। সেই রকম চোখ মুখ ভুরু। ... ...
ইদ মানে উৎসব। ইদ-উৎসবকে ঘিরে আনন্দ স্মৃতি, না বলা কথা, কিম্বা ভীষণ বলতে চাওয়া আখ্যান নিয়ে রইল এবারের ইদের কড়চা। এই কড়চার দুই কিস্তির প্রথমটি বেরোল আজ। ... ...
মকিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, মইশা বলে কতো জল। আল্লাহ সাক্ষী রইল গো। দেখি কে কারে তাড়ায়।’ মাথা এত গরম হয়ে গেল সারা রাত্রি ঘুম হল না। তাঁর উপর ছাদ থেকে শুধু প্লাস্টার খসে পড়ছে। মশারির ভেতর দিয়ে সারা বিছানা বালি বালি হয়ে গেছে। মশারির উপরে একটা চাদর পেতে দিলে হয়। কিন্তু তাতে পাখার হাওয়া একটুও ভেতরে ঢুকবে না। কী করি ভাবতে ভাবতে লোডশেডিং হয়ে গেল। দুত্তোর বলে উঠে পড়লাম। ভাবলাম, কোয়ার্টারের সামনের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করি। সাপের কথা ভেবে আবার মশারির ভেতরে ঢুকলাম। সারা গায়ে প্যাচপ্যাচে ঘাম। তার সাথে বিছানায় বালি ভর্তি। শুয়ে শুয়ে কান্না পাচ্ছিল। কাল আবার ভোর ছ’টা থেকে ডিউটি করতে হবে। ... ...
- কী হয়েছে? তোমরা কোনটা করতে পারনি? - সব পেরেছি মেডাম, কিচ্ছু ছাড়িনি। - তাহলে? ভাইভা কেমন হয়েছে? কে ভাইভা ধরেছেন, কোনো ম্যাডাম নাকি স্যার? - একজন স্যার, একজন মেডাম – দু’জন মিলে ভাগ করে। - যিনি ভাইভা ধরছিলেন, তিনি ঐ কলেজের ইন্টারনাল নাকি এক্সটার্নাল, সেটা জেনেছ? - সেটা জানি না মেডাম, বুঝতে পারিনি। - কী জিজ্ঞেস করেছিলেন? তোমরা কি ভালো করে উত্তর দিতে পারনি? মুখগুলো কেমন ভারভার ঠেকছে। (এবার সমস্বরে) - উত্তর কী দেব মেডাম? দু’জনের কেউ তো ভূগোলের প্রশ্ন তেমন করলেনই না। - সে কী! তাহলে কী ভাইভা হল? ... ...
রমজান এলেই ইদের আমেজ শুরু হয়। শুরু হয় বাস-ট্রেনের টিকিট কাটার তোড়জোড়। মনে জেগে ওঠে বাড়ি ফেরার তাড়া। দিন গোনা শেষে স্বজন-পরিজনের সঙ্গে ইদের আনন্দ ভাগাভাগি করার লক্ষ্যে বাড়ির পথে ছোটা শুরু হয়ে যায়। ... ...
আমি অবাক হয়ে আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কুড়ি টাকা! মাত্র কুড়ি টাকা দিয়ে আম্মা কী বলছে এসব! একটা পিস্তলের দাম ৮ টাকা, ১ টাকা করে বারুদ। একটা বাঁশি দুই টাকা, একটা প্লাস্টিকের চশমা ৫ টাকা। তারপর? ট্রলারখান কেনা হবে না! সে ভারি দাম, অতি দরাদরি করলেও ১৮ টাকার নিচে কুলাবে না। কিন্তু বাদবাকি জিনিস কেনার পর আমার হাতে থাকবে সাকুল্যে ৪ টাকা! তাহলে? তাহলে কী, সব বাদ দিয়ে শুধু ট্রলারখান কিনে ফেলব? ... ...
আমিও আমার মায়ের মতো রাত জেগে ইদের আগের দিন রান্না করি। ইদের দিন বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন মিলে সারাদিন খাই দাই আর আড্ডা দিই। টেবিলে সব সাজানো থাকে, পটে চা থাকে। বেশির ভাগ ইদে আমার মেনু হয় নানা রকম বেকিং গুডস, দুধ সেমাই, জর্দা সেমাই, কখনো কখনো চালের জর্দা, রসমালাই, সরের মিষ্টি, বা নানা রকম নাড়ু, চটপটি, কাবাব বা আলুর চপ। পোলাও, রোস্ট, বিফ কারি, বেগুনবাহার, মাটন চাপ, ইত্যাদি। আর মায়ের ট্রাডিশন ধরে রাখতে সব রকম ডাল দিয়ে খিচুড়ি। ... ...
রোজার শুরু মানেই স্মৃতির বই মেলে ধরে পড়তে শুরু করা। এ যেন নিজেকে আবিষ্কার করা আর শৈশব আর কৈশরে বিপণি বিতানগুলোতে মায়ের হাত ধরে হেঁটে বেড়ানো এক কন্যার হাসি কান্না। ... ...
ইসলামে রমজানের উপবাস মানুষের উপর নিষ্ঠুরভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। শয্যাশায়ী, নিরাময় অযোগ্য রোগী, গর্ভবতী মহিলা, সফরকারী মানুষকে রোজা পালন করা থেকে সাময়িক ছাড় দেওয়া হয়েছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাদের প্রতিকূল অবস্থা দূর হলে তখন তাদের সেই রোজাগুলি করে নিতে হবে। কোন ব্যক্তি উপবাস করে ভুলবসত পেট ভরে খেয়ে নিলেও তার উপবাস ভঙ্গ হয় না। ... ...
ধীরেন্দ্র এস জাফা ভারতীয় বায়ুসেনার ফাইটার পাইলট এবং উইং কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের হাতে যুদ্ধবন্দি হন। পরে মুক্তি পাবার পর তাঁকে বীর চক্র পুরস্কার দেওয়া হয়। বন্দিদশার সেই কাহিনি তিনি লিখছেন তাঁর Death Wasn’t Painful বইটিতে। এই বইটির ১৯ নম্বর পরিচ্ছেদ টির নাম "আয়েশা"। তাঁর পরিবারের সম্মতি নিয়ে সেই পরিচ্ছেদটির কিছু অংশ অনুবাদ করা হল। ... ...
আমার অনেক ইদ ছিল। কৈশোর থেকে যৌবন। সেই বৃত্তান্ত যদি বলি, বলতে হয় আমার ইদ হারিয়ে যাবার বৃত্তান্তও। দুটোরই বড় অবশ্যম্ভাবী আগমন জীবনে। তারও আগে যে সত্য স্বীকার্য – একটা বয়সে যে উৎসবে নতুন জামা জুতোর রং, নির্ঘুম অপেক্ষা, বালিশের নিচে জুতো নিয়ে ঘুমানো আর রান্নাঘরে মায়েদের রাতভর সেমাই পিঠা – তাই ইদ, তাই উৎসব। এই রাতজাগা আনন্দে যতদিন ঘুম টুটে টুটে যায়, ততদিন উৎসব রঙিন। ... ...
ইদের দিনের সবচেয়ে জরুরি কাজ যেটা, মানে নামাজটা পড়ার পরে যখন ইদের আর কোন আইনকানুন থাকে না তখন যা থেকে যায় তা হচ্ছে খাওয়া দাওয়া! এক মাস রোজা রাখার পরে মুখ খুলে গেল, এবার খাও। এই খাওয়ার নানা তরিকা আছে, নানা রঙের আছে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গেলেই চেহারা ভিন্ন হয়ে যায়। ... ...
অনেক সময় দহলিজে খাঁ সাহেবেদের রোজার ব্যবস্থা থাকত অবস্থাপন্নের যৎসামান্য ইফতার দেওয়ার মাধ্যমে। এইভাবেই চলত মাসভর। শেষ রোজায় গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরলে পাড়াতে একসাথে ইফতারের মজলিসে তাদের আনা শহুরে নানা ফলের ডালি খানচায় নিয়ে দোওয়ার মজলিসে সমবেত হত, সব বাড়ির ছোট ছেলেদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মজাই ছিল আলাদা। সেদিনে হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশুনা করার অলিখিত ছুটি মঞ্জুর হতো দু-তিন দিন। ... ...
আগের বছরের মতন এবছরের ইদ-ও এলো অতিমারীর আবহে। রেডরোডের বর্ণাঢ্য নামাজ বন্ধ রাখতে হল। বন্ধ রাখতে হল উৎসবের যাবতীয় সামাজিকতা, আনন্দের দাওয়াত। এই ইদ তাই সংকল্পের ইদ, যাতে রাজনৈতিক উসকানি, প্রশাসনিক অব্যবস্থার ভ্রুকুটি সরিয়ে আমরা শপথ নিই নতুন করে নিজেদের পাশে নিজেরা দাঁড়ানোর। অতিমারীর ভয় যেন মিলনের ইচ্ছেটুকু কেড়ে না নিতে পারে। দুঃস্থ যেন সেবা পায়, নিরন্ন যেন আহার পায়। আর, আমার উচ্ছ্বাস যেন অন্যের বিপদ ডেকে না আনে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেও প্রতিবেশীর দরকারে হাত বাড়িয়ে দেওয়াই হোক এবছরের ইদের কোলাকুলি। ... ...